ইসলামে হিজাব বা পর্দার গুরুত্ব
ইসলামে হিজাব বা পর্দার গুরুত্ব
‘পর্দা প্রথা’ ইসলামের একটি চিরন্তন ও শাশ্বত বিধান, যা মুসলিম নারীর জন্যে ফরযে আইন। ইসলামী যুগের পূর্বে এর কোন ব্যবহার কিংবা ধর্মীয় কোন বিধান-ব্যবস্থা ছিলনা। এটা আল্লাহর অলংঘনীয় বিধান, নির্দেশ। তা আলেমদের মনগড়া কোন একটি নিয়ম বা প্রথা নয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যেমন মুসলিম-মুসলিমা নর-নারীদের ওপর ফরয করা হয়েছে, তদ্রুপ নারীর উপর পর্দাকেও ফরযের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
পুরুষরা নারীদের প্রতি আর নারীরা পুরুষদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানো যাবেনা। অর্থাৎ আকর্ষিক কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে কথা বা তার আদান-প্রদান করা যাবেনা। পরপুরুষ ও পরনারী পরস্পর মধুর সূরে কথা বলা যাবে না, যার কারণে দু’জনের মধ্যে এক ধরনের যৌন লোভ সৃষ্টি হয়। পরপুরুষ ও পর নারী একান্তে যোগাযোগ কিংবা নিজেরা প্রকাশ্য বা অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ও পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য একে অন্যের সামনে উপস্থাপন করতে পারবে না। কারণ পরবর্তীতে তা রূপ নেবে অবৈধ সম্পর্কের। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ভয় তথা তাক্বওয়া যদি মনের ভেতর লুক্কায়িত থাকে, তাহলে এমনটি (পর্দার প্রতি) অনীহা কোন দিনই হবেনা ইনশা-আল্লাহ। কুরআনের ভাষ্যমতে, দৃষ্টি সংযমের বিধান সম্বলিত আয়াত সর্বপ্রথম নাযিল হয়েছে- পুরুষ সমাজের জন্যে। পরবর্তীতে নারীদের জন্যে পর্দা সম্পর্কীয় আয়াত নাযিল হয়েছে। যেমন “মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের স্বীয় দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্যে রয়েছে খুবই পবিত্রতা”। [সূরাতুন-নূর : ৩০ নাম্বার আয়াত]
নারীদের জন্যে পর্দা ব্যবহার করতে বলা হয়েছে (তাদের অভ্যন্তরীণ রূপ-লাবণ্য ঢেকে রাখার উদ্দেশ্যে)। পরবর্তী আয়াতেও পর্দার ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশিকা লিপিবদ্ধ রয়েছে।
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে “তিন ব্যক্তি বেহেশ্তে যেতে পারবেনা : এক, যে বাবা তার সাবালিকা মেয়েকে পর্দায় রাখেনা। দুই, যে স্বামী তার স্ত্রীকে পর্দার ব্যাপারে কড়া হুকুম দেয়না। তিন, যে মহিলা পাতলা ফিনফিনে কাপড় পড়ে সেজেগুঁজে বেপর্দায় চলাফেরা করে জনসমক্ষে”। পর্দা নারীর ভূষণ, নারীর পবিত্রতা, নারীর স্বকীয়তা, আত্মমর্যাদাবোধ, লজ্জা ও ঈমান। পর্দার এ শরী‘ঈ ও গুরুত্বপূর্ণ হুকুমের উপর আমল করলে প্রতিটি মেয়েলোকের ইজ্জত-সম্মান বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। দুনিয়ার জীবনে তাকে তা সুসংহত ও নিরাপদ করে। সূরা নূরের ৩১ নম্বর আয়াতে নারীদের উদ্দেশে আল্লাহ পাক বলেছেন- ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে আর তাদের লজ্জাস্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করে ও নিজেদের দেহের রূপ-লাবণ্য তথা সৌন্দর্য প্রকাশ্যে (যাদেরকে বিয়ের জন্যে হালাল করা হয়েছে) তাদের সামনে প্রদর্শন না করে, কেবল সেসব অংশ ছাড়া, যা আপনা আপনিই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। আর যেন তারা তাদের মাথার কাপড় দিয়ে বুকের ওপরটা ঢেকে রাখে। যখন সে রাস্তায় বের হবে তখন কিংবা গায়র মুহরিম ব্যক্তিদের সামনে তা প্রদর্শন না করে-শুধু তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুড়, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, নিজ অধিকারভূক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক যারা নারীদের গোপনাঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ তারা ব্যতীত। আর তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার জন্যে জোরে পদচারণা না করে। হে মু’মিনগণ! তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর নিকট তাওবাহ কর, আশা করা যায় তোমরা কল্যাণ লাভ করবে। [সূরাতুন নূর : ৩১ নম্বর আয়াত]
পুরুষদের চোখের পর্দা কিংবা অন্তরের পর্দা সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি কোন মহিলার দিকে হঠাৎ চোখের দৃষ্টি পড়ে যায়, তাৎক্ষণিকভবে দৃষ্টি সরিয়ে নেবে এবং তার দিকে দ্বিতীয় দৃষ্টি দেবেনা। দ্বিতীয় বারের দৃষ্টি কিন্তু ক্ষমাযোগ্য নয়।
এমনই রূপ-লাবণ্য, নারীর কন্ঠ শুনা, (মধুর সুরে) কথা বলা, একজন আরেকজনের উদ্দেশ্যে ভাল লাগার বিষয়াদি শেয়ার করা, কিংবা অংগভংগীর বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে মনের ভালবাসার জানান দেয়া, এ সবগুলোই অনুমতি পাবে তার একমাত্র নিজের স্ত্রীর সাথে করার ও দেখার, অন্য কোনও মেয়ে লোকের বেলায় এসব কিছু ভাবা এবং একান্ত মনে অন্যের চেহারা সর্বান্তকরণে অনুভব করা হারাম।
‘হিজাব, কিংবা ‘পর্দা’ ফ্যাশনের কোন প্রতীক নয়, সৌন্দর্য বর্ধনের কোন সামগ্রী নয়। এটা আল্লাহ তা’আলার হুকুম ‘ফরযে আইন’ প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র (প্রাপ্ত বয়স্ক) উম্মাতের নর-নারীর ওপর। এই আইনের প্রবর্তক স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই। তাই তাঁর আদেশ নিষেধ যদি কেউ জেনে শুনে মান্য করা থেকে নিজেকে দূরে রাখে তবে সে যেন কুরআনে আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশকেই অবজ্ঞা করে। আল্লাহর ভাষায় “যারাই আমার আয়াতসমূকে অবজ্ঞা করবে, আমি তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবো। তাদের চামড়াগুলো যখন জ্বলেপুড়ে যাবে, তখন আমি সেখানে নতুন চামড়া দেব, যাতে তারা সে আযাব পূর্ণভাবে আস্বাদন করতে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী। [সূরাতুন নিসা : ৫৬ নম্বর আয়াত]
মেয়েদের জন্যেও যা দেখানোর কিংবা প্রদর্শন করার অনুমতি দেয়া হয়েছে তা শুধু তার স্বামীর সামনে ও স্বামীর সাথেই। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, “হে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনি আপনার স্ত্রীগণ ও কন্যাদেরকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবেনা।” [সূরাতুল আহযাব : ৫৯ নম্বর আয়াত]
আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা আরো বলেছেন, পার্থিব জীবনের ওপর কাফিরদেরকে উন্মাদ করে দেয়া হয়েছে। আর তারা ঈমানদারদের প্রতি লক্ষ্য করে হাসাহাসি করে। পক্ষান্তরে যারা পরহেজগার তারা সেই কাফেরদের তুলনায় কিয়ামতের দিন অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদায় থাকবে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে সীমাহীন রুযী দান করেন। [সূরাতুল বাক্বারাহ : ২১২ নম্বর আয়াত]
হিজাবের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে নিজের রূপ-মাধুর্য ঢেকে বের হওয়া, পোশাকে ও চাল-চলনে এবং অপরের সাথে কথা বার্তায় যেন পর্দার মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, নারী পুরুষকে এমনভাবে কথা বলবে না যেন কন্ঠ শুনে উক্ত নারী তার প্রতি আকৃষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে। এমন সব ব্যক্তিগত গুণাবলীও নারীর সামনে প্রকাশ করবে না, যাতে করে সে ধীরে ধীরে ওই পুরুষের প্রতি দুর্বল হতে থাকবে। তদ্রুপ নারীরা নিজেদের মধুর কণ্ঠস্বর এবং ব্যক্তিগত গুণাবলী পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করবে না পর পুরুষকে আকৃষ্ট করার জন্যে। একটি মেয়ে খুব সহজেই একজন পুরুষের জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এমন নজীর অহরহ। গুণাহের শুরুটা অত্যন্তই মিষ্ট কিন্তু শেষটা অনেক তিক্ততায় ভরা। একজন মেয়ের হাসি-কান্না, চাহনি, চলন সব কিছুতেই রয়েছে পুরুষের আকর্ষণ। সেই আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে কখন যে তা পুরুষের অন্তরে ভালবাসার সৃষ্টি হয় সেটা দু’জনই বুঝে উঠতে পারেনা। আর এভাবেই শুরু হয় দুটো নর-নারীর গুনাহের পথ চলা। সে চলাতেই একজন পুরুষ কখন কল্পনার সাগরে হারিয়ে যায় তা সে নিজেও জানেনা। এমন সব বিষয় থেকে বিরত থাকতে গ্রহণ করতে হবে “তাক্বওয়া” বা পরহেজগারী। স্বামীদের জীবন যেন কোনও বেগানা নারী দ্বারা ভবিষ্যৎ গুনাহের অতল সাগরে তলিয়ে না যায়, অনুরূপ কোনও বেগানা পুরুষ দ্বারা যেন কোন মেয়েলোকের জীবনও যেন গুনাহের অতল গহ্বরে তলিয়ে না যায় এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এটাই আমাদের সবার প্রার্থনা মহান স্রষ্টার পবিত্র দরবারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- পুরুষেরা গন্ধ পাবে এমন উদ্দেশ্যে আতর বা সুগন্ধি মেখে কোন মহিলা যদি পুরুষদের মাঝে চলাচল করে তাহলে সে একজন যিনাকারী মহিলা হিসেবে গণ্য হবে।
[আহমদ : ৪/৪১৮, সাহীহুল জা’মে হাদীস-১০৫]
শরীয়াতের নিষেধাজ্ঞায় আছে, “মেয়েরা ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় যেন সুগন্ধি ব্যবহার না করে। ওই সুগন্ধিকে মেয়েদের নামাজের জন্য হারামও করা হয়েছে। যতক্ষণ ওই সুগন্ধিকে ধুয়ে নেবেনা এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তার শরীর থেকে ওই সুবাস পাওয়া যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার নামাজ গৃহীত হবেনা। [আহমদ-২/৪৪৪, সাহীহুল জামে, হাদীস নং-২৭০৩]
আমাদেরকে এসব আমল ঠিকভাবেই পালন করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে কিভাবে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হবো? মহান সাহাবীরা যেকোনও আমল এত সতর্কতার সাথে করেও, এত বিনয় এবং আদবের সাথে করেও সব সময় ভয় করতেন আল্লাহ কবুল করেন কিনা? আল্লাহ তা’আলা পাকড়াও করেন কিনা? এত আমল করার পরেও তাঁরা সব সময় আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকতেন। আল্লাহ আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করনা। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“। [সূরাতুল বাক্বারাহ : ২০৮ নম্বর আয়াত] আমরা যদি কল্যাণ লাভ করতে চাই, তবে আমাদের উচিত হবে ইসলামের বিধি-বিধানগুলো পরিপূর্ণরূপে মেনে চলা যেভাবে কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
‘হিজাব’ বা পর্দার নিয়মকানুন কুরআন ও হাদীসে যেভাবে উল্লেখ আছে
১। প্রধানত : পুরুষের নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকতে হবে। মেয়েদের জন্যে মুখ আর হাতের কবজি ব্যতীত, (কিছু কিছু গ্রহণযোগ্য অভিমত আনুসারে) মুখসহ সমস্ত শরীর ঢাকতে হবে। কেননা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মেয়ে মানুষের শরীরের সব জায়গাতেই লজ্জার গোপনীয় আভাষ বিদ্যমান। আর সে যখন বের হয় তখন শয়তান তাকে পুরুষের দৃষ্টিতে সুশোভনীয় করে তোলে। [তিরমিযি, মিশকাত- ৩১০৯] ২। যে পোশাক পরিধান করবে, সেটাই যেন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সৌন্দর্যময় ও দৃষ্টি আকর্ষণকারী না হয়। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেন, সাধারণত যা প্রকাশ হয়ে থাকে তা ছাড়া তারা যেন তাদের অন্যান্য সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। [সূরাতুন নূর- আয়াত : ৩১] ৩। পোশাকটি যেন এমন পাতলা না হয়, যাতে কাপড়ের ওপর থেকেও ভিতরের চামড়া নজরে আসে। নচেৎ
ঢাকা থাকলেও খোলার পর্যায়ভুক্ত। একদা হাফসা বিনতে আব্দুর রহমান পাতলা ওড়না পরে হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এর নিকট গেলে তিনি তার ওড়নাকে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন এবং তাকে একটি মোটা কাপড়ের ওড়না পরতে দিলেন। [মুআত্তা-ই ইমাম মালেক, মিশকাত- ৪৩৭৬ নং] একজন নারীর বেপর্দাভাবে চলাফেরা করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। নারীর পর্দা বা হিজাব শুধু তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ঢেকে রাখার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা বরং এমনভাবে তাকে হিজাব পরতে হবে, যাতে ভিন্ন কোন পুরুষ কোনভাবেই তার দিকে আকর্ষণের দৃষ্টি নিক্ষেপ করার সুযোগ না পায়। আল্লাহ, আমরা নারী সমাজকে যেন সম্মানের পথ চলার তাওফিক দান করেন, মুমিনা, ক্বানিতাত, ছালিহাত, ছাদিক্বাত ও হাফিজাহ্দের অন্তর্ভূক্ত করেন। আর জীবনের মূল্যবান সময়টুকু শরীয়াতের বিধানানুসারে অতিবাহিত করার সুযোগ দেন। মেয়েদের পোশাক যেন খুবই টাইটফিট না হয় যাতে দেহের উচু নিচু গড়ন, পাতলা কিংবা মোটা প্রকাশ্যে ধরা পড়ে পরপুরুষের দৃষ্টিতে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য (লেবাসে, পোশাকে, চাল-চলনে) অনুকরণ করবে, অবলম্বন করবে সে তাদেরই দলভূক্ত হবে। [আবু দাউদ, মিশকাত ৪৩৪৭]
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মেয়েদের পোশাক যেন বিপরীত লিঙ্গের পোশাকের অনুরূপ না হয়। তিনি ওইসব নারীকে অভিশাপ দিয়েছেন, যারা পুরুষদের বেশ ধারণ করে এবং সেই পুরুষদেরকেও অভিশাপ দিয়েছেন, যারা নারীদের বেশ ধারণ করে। (আবু দাউদ, ৪০৯৭, ইবনে মাজাহ ১৯০৪)। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধিজনক লেবাস-পোশাক পরিধান করবে আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন।
[আহমদ, আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত- ৪৩৪৬]
পোশাকের পাশাপাশি চোখ, মন, চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এমনকি মনের অভিপ্রায়কেও সুসংহত ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বিশেষ করে মেয়েদের উদ্দেশ করে নবী করীমের বাণী যা চিরন্তন সত্য কষ্মিনকালেও এ উক্তিগুলোকে কোনভাবেই উপেক্ষা করতে পারবোনা :
১। স্ত্রী যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সঠিকভাবে আদায় করে, ২। পবিত্র রামাদ্বান মাসে রামাদ্বানের রোযা পালন করে, ৩। নিজের সম্ভ্রম (তথা লজ্জাস্থানের) হিফাজত করে, ৪। স্বামীর আনুগত্য পোষণ করে, তখন সে জান্নাতের যে কোনও দরজা দিয়ে বেহেস্তে প্রবেশ করতে পারবে। অর্থাৎ তাদেরকে জান্নাতী নারী হিসেবে নবী করীম ঘোষণা করেছেন। তাই মেয়েদের জন্যে বেহেস্তের পথ একেবারেই সহজ ও সুগম, কন্টকাকীর্ণ নয় বরং কুসুমাস্তীর্ণ।
হযরত আবূ উমাইনা ছাদফী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম, যারা আল্লাহকে ভয় করার পাশাপাশি স্বামীকে ভক্তি করে, অধিক সন্তান জন্ম দেয় এবং (স্বামীর দুঃখে তার প্রতি) সমব্যথিত ও সহানুভতিশীল হয়। পক্ষান্তরে তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সবচে মন্দ তারাই, যারা বেপর্দা হয়ে দম্ভ ভরে চলে। এরা জান্নাতে প্রবেশ করবে (কেবল লাল ঠোঁট ও পা বিশিষ্ট কাকদের সাথে, সংখ্যায় অনেক কম)। [বায়হাক্বী- ১৩৪৭৮]
ইসলামী শরিয়া মতে মেয়েদের পর্দার মূল উদ্দেশ্যটা হচ্ছে কোনও পুরুষ যেন মেয়েদের উন্মুক্ত চেহারার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে তার সম্ভ্রম হারিয়ে না ফেলে কিংবা এতে করে সমাজে সে যেন নিজেকে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া থেকে দূরে রাখে। একথা সর্বজন বিদিত যে, চেহারাটাই হচ্ছে মেয়েজাতির সৌন্দর্য প্রকাশের মূল বহি:প্রকাশ। আর তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেয়া হয় যে, কোন কোন সাহাবী থেকেতো চেহারা খোলা রাখার কথা বর্ণিত হয়েছে, তাহলে আমাদেরকে দেখতে হবে অন্য সমস্ত সাহাবা-ই কেরামের আমল কিরূপ ছিল। পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পর থেকে কোন মহিলা সাহাবীর কি এমন ঘটনাও খুঁজে পাওয়া যাবে, যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাঁর চেহারা খোলা ছিল? কুরআন হাদীস সাহাবায়ে কেরামের সামনে নাযিল হয়েছিল তারা যে ব্যাখ্যা বুঝেছেন এবং আমল করেছেন, আমাদেরকেও সেটাই অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন- তোমরা তাঁর পত্নীগণের কাছে কিছু পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। [সূরাতুল আহযাব : আয়াত ৫৩]
এ আয়াতের শানে নূযুল বর্ণনায় বিশেষভাবে নবী-পত্নীগণের কথা উল্লেখ থাকলেও এ বিধান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমগ্র উম্মাতের জন্য নাযিল হয়েছে। উক্ত (বিধানের) আয়াতের সারমর্ম এই যে, বেগানা মহিলার নিকট থেকে পরপুরুষদের কোন ব্যবহারিক বস্তু, পাত্র, ইত্যাদি নেয়ার প্রয়োজন হলে পুরুষগণ সামনে এসে নেবে না, বরং আড়াল থেকে চাইবে। আরও বলা হয়েছে- পর্দার এ বিধান নারী পুরুষ উভয়ের অন্তরকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে পবিত্র রাখার উদ্দেশ্যেই দেয়া হয়েছে। [সূরাতুল আহযাব : আয়াত ৫৩]
উক্ত আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূণ্যাত্মা পবিত্র পত্নীগণকে পর্দার বিধান দেয়া হয়েছে, যাঁদেরকে সামাজিকভাবে ও সামগ্রিকভাবে পাক-সাফ কিংবা কলুষমুক্ত রাখার দায়িত্ব আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং গ্রহণ করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে, তিনি কেবল তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত:পবিত্র রাখতে চান। [সূরা আহযাব-৩৩]
আরো বলেন, “হে মুমিন মহিলাগণ! তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং পূর্বের জাহেলী যুগের ন্যায় নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বের হবেনা। [সূরা আহযাব-৩৩]
ইসলাম পূর্ব যূগে নারীরা যেভাবে অজ্ঞতা ও অন্ধকার যুগে প্রকাশ্যভাবে বেপর্দায় ঘুরে বেড়াত, চলাফেরা করতো, তোমরা কখনো সেভাবে চলাফেরা করো না। প্রকৃতপক্ষে, নারীদের বাড়ীর বাইরে না যাওয়াটাই আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ। গৃহের অভ্যন্তরীণ কর্ম সম্পন্ন করার জন্যেই যাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে মূলত, যেমন পতির সেবাযত্ন অর্থাৎ স্বামীর আনুগত্য, সন্তানদেরকে দ্বীনি ও কুরআনী শিক্ষার অন্তর্গত ইবাদতসমূহ সম্পর্কে অবহিত করার লক্ষ্যে নিজেকে একান্তভাবে নিবিষ্ট করে রাখা। আর নারীকে যদি প্রয়োজনের তাগিদে ঘর থেকে বের হতেই হয়, তাহলে বের হওয়া জায়েয আছে বটে, কিন্তু শর্ত হলো- চেহারা এবং পুরো শরীর বড় চাদরের আবর্তে রেখে সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে বের হতে হবে। অন্যথায় একজন নারীর জন্যে তার সর্ব প্রথম বাবা, ভাই, স্বামী, পুত্র সবাই গুনাহগার হয়ে যাবে। আমাদের নবী-ই আকরামের বাণী হচ্ছে- খবরদার! তোমরা বেগানা স্ত্রীলোকের ঘরে প্রবেশ করোনা। তখন জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইকা ওয়াসাল্লামা, স্ত্রীলোকদের জন্য স্বামীর ভাইদের (দেবর, ভাশুড়, বেহাই) সম্পর্কে কী নির্দেশ? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তারা তো তোমাদের স্ত্রীগণের জন্যে মৃত্যুতুল্য। [তিরমিযি শরীফ : ১/২২০]
মৃত্যুকে মানুষ যেভাবে ভয় পায়, বেপর্দার গুনাহ থেকে বাচাঁর জন্যে শ্বশুড় বাড়ীর সকল গায়র মুহরিমদেরকেও তেমনি ভয় করার জন্যে নির্দেশ এসেছে উক্ত হাদীসে। অপর এক বর্ণনায় হযরত উম্মে সালামা (উম্মুল মু’মিনীন)
রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা হতে বর্ণিত, আমি এবং মায়মুনা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। ইতিমধ্যে অন্ধ সাহাবী হযরত ইবনে উম্মে মাকতুম সেখানে আসতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন “তোমরা তার থেকে পর্দা করো, আড়ালে চলে যাও।” আমি বললাম, এয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইকা ওয়াসাল্লাম, তিনি তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছেন না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তোমরাও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছনা?” [আবূ দাঊদ শরীফ, ২/৫৬৮]
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম একজন পূতঃপবিত্র স্বভাবের অধিকারী, পূণ্যবান মহান বুযুর্গ সাহাবী, অপরদিকে হযরত উম্মে সালামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা এবং হযরত মায়মূনা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা উভয়ই উম্মত-জননী এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন সঙ্গিনী। বলতে গেলে তাঁদের বেলায় কুদৃষ্টির কথা কল্পনাও করা যায় না, তাই এর প্রশ্নই আসছেনা। তথাপিও পর্দা করাটা কত যে জরুরী সেটাই বুঝে নেয়ার জন্যে এ হাদীসটির উল্লেখ্য বিষয়। সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাবৃন্দ! ইসলাম একপেশে কোন জীবন ব্যবস্থা নয়। যে কোন মুহুর্তেই মানুষের জীবনকে উলট পালট করে দিতে পারে এমন একটি বিষয় হচ্ছে যৌনতা, যা হিজাব বা পর্দা না করার কারণেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সে বিষয়ে কুরআনে এত বেশি আয়াত ও হাদীস উল্লেখিত হয়েছে যে, সবগুলো এখানে বর্ণনা করা সম্ভব নয়, একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে গেলে কলেবর অনেক বৃদ্ধি পাবে, তবুও আমাদের অনেক কিছুই অজানা থেকে যাবে, এতদসত্ত্বেও কিছুটা আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি।
কুরআনের ভাষায়
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারীর জন্য অন্য কিছু এখতিয়ার বা ইচ্ছে করার অধিকার থাকেনা; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অমান্য করে, সে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্ট হবে। [সূরাতুল আহযাব : আয়াত নম্বর- ৩৬]
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, আমরা বিয়ের সময় পাত্র-পাত্রীর দেখাশুনা ও নির্বাচন কিভাবে করবো পর্দার এমন কঠোর আদেশ-নিষেধ উপেক্ষা করে? হ্যাঁ এর উত্তর হচ্ছে ইসলাম এর অনুমতিও দিয়েছে। কারণ মানব জীবনে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিয়ের আগে শরীয়ত সম্মত পদ্ধতিতে মেয়ে-ছেলেকে, আর ছেলে মেয়েকে দেখে নেয়া এবং পাত্রী নির্বাচন করা জরুরী। যেহেতু একজন অন্যজনকে জেনে নেয়ার পর দাম্পত্য জীবনে স্বস্তি ও প্রশান্তি বিরাজমান থাকবে বলে আশা করা যায়। এই প্রশান্তিটা নর-নারীকে তাদের নিজেদেরকে চারিত্রিক পবিত্রতা অক্ষুন্ন রাখতে সাহায্য করে। হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট এসে বললেন, আমি এক আনসারী মহিলাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। তখন নবী করীম বললেন, মেয়েটিকে দেখে নাও। আনসারীদের চোখে সমস্যা থাকে। [মুসলিম শরীফ]
শান্তির ধর্ম ইসলামে শান্তির বাণীই আমরা শুনতে পাই। কুরআন ও হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মেয়েরা পর্দা তথা মোটা ও ঢিলাঢালা পোষাক দ্বারা চেহারাসহ সারা শরীর ঢেকে চলাফেরা করবে এবং পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের বেলায়ও তারা শুধুমাত্র চেহারাটা খোলা রাখার এবং দু’হাত, দু’পা দেখার অনুমতি দিয়েছে। যেমনটি নামাজ ও হজ্বের সময়কার শরীয়তের বিধান লঙ্ঘণীয়। একটি হাদীস, হযরত আয়েশা সিদ্দিক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, হজ্বের সময় আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে ছিলাম-হজ্বের সফরকালে পথিমধ্যে কোন কাফেলার মুখোমুখী হলে আমরা আমাদের চেহারার ওপর নেকাব ফেলে দিতাম। অতঃপর তারা পথ অতিক্রম করে চলে গেলে আবার নেকাব তুলে দিতাম। [আবু দাউদ শরীফ]
*উপসংহারঃ
আমরা এটাই বলতে পারি যে, মেয়েরা যখন বালেগা হওয়ার কাছাকাছি পর্যায়ে পৌছে যায় (অর্থাৎ- তারা নিজেরা অনুধাবন করতে পারার মতো জ্ঞান ও বিবেক হয়) এবং তাদের দিকে তাকালে পর পুরুষের কামভাব সৃষ্টি হয়, তখন থেকেই তাদেরকে পর্দার আওতায় নিয়ে আসাটা জরুরী। [আহসানুল ফাতওয়া ৮/৩৭]
ইসলাম নারীজাতিকে অতি উচ্চ সম্মান দান করেছে। অনুশাসনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের লজ্জাস্থানের হেফাজাতের হুকুম বা বিধান দিয়েছে। আমরা ভাগ্যবান জাতি, মুসলিম জাতি হিসেবে এবং নারী জাতি হিসেবেও ভাগ্যবতী যেহেতু ইসলাম ধর্মের পতাকাতলে আমরা স্থান পেয়েছি। আল্লাহ তায়ালা সকল মুসলিম নারীদের যেন উম্মুল মু’মিনীনদের আদের্শে জীবন পরিচালনা করার তৌফিক দান করেন। #আমীন।